সূচিপত্র

ভারতীয় সংবিধানের বৈশিষ্ট্য

ভূমিকা

ভারতীয় সংবিধানে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান, যা একে অন্যান্য সংবিধান থেকে স্বতন্ত্র করেছে। গণপরিষদে ড. আম্বেদকর দাবি করেছিলেন, বিভিন্ন রাষ্ট্রের সংবিধানের শ্রেষ্ঠ বিষয়গুলিকে ভারতের প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে স্থান দেওয়া হয়েছে। তবে প্রতিটি রাষ্ট্রের শাসকশ্রেণি তাদের ধ্যানধারণা, চিন্তাভাবনা ও স্বার্থের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করে, তাই শাসকশ্রেণির স্বার্থবিরোধী কোনো বিষয় সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না।

প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ

বিশ্বের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ ও জটিল সংবিধান

১. ভারতীয় সংবিধান বিশ্বের বৃহত্তম ও জটিল সংবিধান। এতে বর্তমানে প্রায় ৪৬০টি ধারা, অসংখ্য উপধারা এবং ১২টি তপশিল রয়েছে, যা একে অন্যান্য সংবিধান থেকে আলাদা করেছে।

ব্রিটিশ রাজের প্রভাব লক্ষণীয়

২. ভারতীয় সংবিধানের প্রণেতারা ব্রিটিশ সংবিধান এবং ভারত শাসন আইনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। যেমন, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অধিকাংশ বিষয় সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

লিখিত ও অলিখিত সংবিধানের সংমিশ্রণ

৩. সংবিধানটি মূলত লিখিত হলেও কিছু প্রথা, রীতিনীতিও অন্তর্ভুক্ত আছে, যেমন লোকসভায় পরাজয়ের পর মন্ত্রীসভা পদত্যাগ করে, যা একটি প্রথা হিসেবে গড়ে উঠেছে।

সুপরিবর্তনীয় ও দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানের সংমিশ্রণ

৪. সংবিধান কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তনযোগ্য ও কিছু ক্ষেত্রে অপরিবর্তনীয়। উদাহরণস্বরূপ, সাধারণ সংশোধনের জন্য সংসদের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রয়োজন, কিন্তু মৌলিক অধিকারের পরিবর্তনে দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থনের প্রয়োজন।

সংবিধানের প্রাধান্য

৫. ভারতের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান এবং এটি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও নাগরিক অধিকারের উৎস। সরকার সংবিধান-বিরোধী আইন প্রণয়ন করলে সুপ্রিমকোর্ট সেই আইন বাতিল করতে পারে।

সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র

৬. ভারতকে একটি "সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র" বলা হয়, যেখানে সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

ভারতীয় শাসনব্যবস্থার অন্যান্য বৈশিষ্ট্য

যুক্তরাষ্ট্রীয় ও এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা

৭. ভারতীয় সংবিধান যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে অনুসরণ করে, কিন্তু কেন্দ্রের প্রাধান্য রয়েছে। সংবিধান ভারতের যুক্তরাষ্ট্র-প্রতিম কাঠামোকে যুক্তরাষ্ট্রীয়তা ও এককেন্দ্রিকতার মিশ্রণে সংজ্ঞায়িত করেছে।

রাষ্ট্রপতিশাসিত ও মন্ত্রীসভাপরিচালিত সরকারের মধ্যে সমন্বয়

৮. ভারতে মন্ত্রীসভাপরিচালিত সরকার আছে, তবে রাষ্ট্রপতি দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রীসভা কার্যত শাসনকার্য পরিচালনা করে।

ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির অনুপস্থিতি

৯. ভারতে সংসদীয় শাসনব্যবস্থার ফলে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি কার্যকর হয় না, এবং বিচারপতি নিয়োগের ব্যাপারে শাসন বিভাগের ক্ষমতা অধিক।

নাগরিকদের মৌলিক অধিকার

১০. ভারতীয় সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার স্বীকৃত হয়েছে:

  • সাম্যের অধিকার
  • স্বাধীনতার অধিকার
  • শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার
  • ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার
  • শিক্ষা ও সংস্কৃতির অধিকার
  • সাংবিধানিক প্রতিবিধানের অধিকার

তবে কিছু পরিস্থিতিতে এবং জরুরি অবস্থায় এগুলি খর্ব করা যেতে পারে।

মৌলিক কর্তব্যসমূহের অন্তর্ভুক্তি

১১. সংবিধানের ৫১-ক নং ধারায় ১১টি মৌলিক কর্তব্য উল্লেখ রয়েছে, যা নাগরিকদের প্রতিপালনীয়।

রাষ্ট্রপরিচালনার নির্দেশমূলক নীতি

১২. রাষ্ট্রপরিচালনার কিছু নীতি রয়েছে, যা জনকল্যাণমুখী সমাজ গঠনের উদ্দেশ্যে প্রণীত। এগুলি আইনত বলবৎযোগ্য না হলেও, রাষ্ট্রকে একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্রে পরিণত করতে সহায়ক।

ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের আদর্শ

১৩. ভারতীয় সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের নীতিকে স্বীকৃতি দেয়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদির ভিত্তিতে বৈষম্য করা নিষিদ্ধ।

দলত্যাগ নিরোধক আইন

২২. দলত্যাগ রোধে ৫২-তম সংবিধান সংশোধন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, যা সংসদীয় গণতন্ত্রের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করেছে।

সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার

২৩. সংবিধানে ১৮ বছর বয়সের পর সকল নাগরিককে ভোটাধিকার দেওয়া হয়েছে।

জম্মু ও কাশ্মীরের 'বিশেষ মর্যাদা'

২৪. জম্মু ও কাশ্মীরকে ৩৭০ নং ধারা অনুযায়ী বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, যার অধীনে রাজ্যের আলাদা সংবিধান, কিছু বিশেষ অধিকার ও প্রক্রিয়া রয়েছে।

উপসংহার

ভারতীয় সংবিধানের বৈশিষ্ট্যগুলি একে বিশেষ করে তুলেছে। জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রের আদর্শে পুঁজিবাদী শক্তির সমর্থনে এটির গঠন হয়েছে বলে সমালোচনা করা হয়, তবে এটি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও সামাজিক কল্যাণের মধ্যে সমন্বয় স্থাপন করে একটি ব্যতিক্রমী সংবিধান হিসেবে গণ্য হয়।

4.5 / 5

- (24 votes)