ভূমিকা
প্রতিটি দেশের সংবিধানের নিজস্ব দর্শন থাকে, যা সেই দেশের সংবিধানের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। ভারতীয় সংবিধানের দর্শনের অনুসন্ধান করলে, গণপরিষদে জওহরলাল নেহরু কর্তৃক উত্থাপিত উদ্দেশ্যসমূহ-সংক্রান্ত প্রস্তাবের (Objectives Resolution) দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হয়। ১৯৪৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর উত্থাপিত এবং ১৯৪৭ সালের ২২ জানুয়ারি গৃহীত এই প্রস্তাবের আদর্শই স্বাধীন ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বিশেষভাবে স্থান পেয়েছে।
প্রস্তাবনার প্রকৃতি ও তাৎপর্য
প্রকৃতি
ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনা সংবিধানের একটি অংশ কি না, এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, আয়ারল্যান্ড, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের সংবিধানে প্রস্তাবনা সংযুক্ত রয়েছে। ভারতীয় সংবিধানে প্রস্তাবনার গুরুত্ব থাকলেও এটি কার্যকরী অংশ নয়, বরং এটি সংবিধানের উদ্দেশ্য ও নীতিসমূহের একটি মুখবন্ধ।
সংবিধানের অংশ হলেও কার্যকরী অংশ নয়
যদিও প্রস্তাবনাটি সংবিধানের অংশ হিসেবে বিবেচিত, এটি কার্যকরী অংশ নয়। সংবিধানের বিভিন্ন ধারার সাধারণ উদ্দেশ্য খুঁজে পাওয়া যায় প্রস্তাবনায়, তবে সংবিধানের মূল অংশের সঙ্গে বিরোধ দেখা দিলে মূল অংশকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়।
আইনগত গুরুত্ব যথেষ্ট কম
আইনগতভাবে প্রস্তাবনার গুরুত্ব কম হলেও এর নৈতিক গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। বিভিন্ন আদর্শ ও নীতি সংবিধানের মূল অংশেই কার্যকরীভাবে রক্ষিত এবং নিয়ন্ত্রিত হয়।
প্রস্তাবনার তাৎপর্য
সংবিধানের অস্পষ্টতা দূরীকরণে প্রস্তাবনার ভূমিকা
সংবিধানের কার্যকরী অংশের কোনো শব্দ বা বাক্যের অর্থ অস্পষ্ট থাকলে প্রস্তাবনার সাহায্যে অর্থ পরিষ্কার করা যায়। পশ্চিমবঙ্গ বনাম আনোয়ার আলি সরকার (১৯৫২) মামলায় এই বিষয়টি উত্থাপন করা হয়েছিল।
সংবিধান-রচয়িতাদের মনোভাবের চাবিকাঠি
প্রস্তাবনা সংবিধান-প্রণেতাদের মনোভাব বোঝার জন্য একটি চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করে। এটি সংবিধানের দার্শনিক ভিত্তিকে স্পষ্ট করে তোলে।
সংবিধানের দার্শনিক ভিত্তি স্বরূপ
প্রস্তাবনা ভারতীয় সংবিধানের দার্শনিক ভিত্তিকে তুলে ধরে। এতে গণ-সার্বভৌমিকতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সাধারণতন্ত্রসহ বিভিন্ন মৌলিক আদর্শ ঘোষিত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গুরুত্ব
প্রস্তাবনায় ভ্রাতৃত্ববোধের গুরুত্ব শুধু জাতীয় ক্ষেত্রেই নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও সমান গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত। এটি ভারতের পররাষ্ট্রনীতিরও একটি ভিত্তি।
নৈতিক গুরুত্ব
আইনগত দিক থেকে প্রস্তাবনার গুরুত্ব কম হলেও, এটি একটি নৈতিক নির্দেশনা হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রস্তাবনায় ঘোষিত নীতি ও আদর্শ সরকারকে নৈতিকভাবে রূপায়িত করতে বাধ্য করে।
সমালোচনা
- ভারতীয় গণপরিষদের অগণতান্ত্রিক প্রকৃতি: গণপরিষদের সদস্যরা সর্বজনীন ভোটে নির্বাচিত হননি।
- সংবিধানকে গণভোটে পেশ করা হয়নি: সংবিধান রচিত হওয়ার পর গণভোটে পেশ করা হয়নি।
- ভারতীয় সংবিধানের উৎস ব্রিটিশ আইন: ভারতীয় সংবিধান ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত।
- গণপরিষদের প্রক্রিয়াশীল চরিত্র: গণপরিষদের সদস্যদের একটি অংশ রক্ষণশীল সামন্ততন্ত্রের মুখপাত্র ছিলেন।
সমালোচনার উত্তর
- প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিবেশ: তৎকালীন পরিস্থিতিতে গণপরিষদ গঠন ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না।
- অপরিবর্তিত গঠন প্রকৃতি: প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে নির্বাচিত হলেও পরিষদের প্রকৃতিতে কোনো পরিবর্তন আসত না।
- গণপরিষদ রচিত সংবিধানের প্রতি জনসমর্থন: সংবিধান প্রবর্তিত হওয়ার পর নতুন আইনসভা সংবিধানকে গ্রহণ করেছিল।
- জনগণ সার্বভৌম কর্তৃত্বের আধার: ভারতের জনগণ সংবিধানের সার্বভৌমত্বের মূল ভিত্তি।
উপসংহার
ভারতীয় সংবিধানের বিভিন্ন ধারা এবং সমকালীন রাজনীতির দিকনির্দেশনা দেখে বোঝা যায়, ভারতে গণসার্বভৌমিকতা কার্যত প্রভাবশালী শ্রেণির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
- (24 votes)
0 মন্তব্যসমূহ