সূচিপত্র

1942 সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে গান্ধীজির নেতৃত্বে পরিচালিত সর্বভারতীয় গণ আন্দোলনগুলির মধ্যে অন্যতম আন্দোলন ছিল ভারত ছাড়ো আন্দোলন। এই আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে। অন্যান্য আন্দোলনের মতো সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছিল, বিশেষ করে কৃষক শ্রেণি। বাংলা ও বিহার এই আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র ছিল। গান্ধীজীর নেতৃত্বে পরিচালিত সর্বভারতীয় গণ আন্দোলনের মধ্যে এটি ছিল শেষ আন্দোলন, যেখানে বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণী এবং শ্রমিকরাও অংশগ্রহণ করে। উচ্চ থেকে নিম্নবর্ণের মানুষ একসাথে স্বাধীনতা আদায়ের লক্ষ্যে যোগদান করেছিল। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব বিভিন্ন নেতা-নেত্রীদের দ্বারা পরিচালিত হয়, যা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্ববহ।

ভারত ছাড়া আন্দোলনের ঐতিহাসিক তাৎপর্য

জাতীয় কংগ্রেসের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা

গান্ধীজীর দীর্ঘ অনশনের ফলে কংগ্রেসের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। এর মাধ্যমে কংগ্রেস নেতাদের আত্মত্যাগের ঘটনা সমগ্র জাতিকে আবেগে আপ্লুত করে তোলে।

গণবিদ্রোহের চরিত্র

ছাত্র, কৃষক, নারী এবং শ্রমিক শ্রেণির মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে, যা বাংলা, বিহার এবং অন্যান্য অঞ্চলে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রচেষ্টা

যদিও মুসলিম লীগ অংশগ্রহণ করেনি, তবুও হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য দেখা যায়। বিহার, উত্তরপ্রদেশ, শিলচর ও চট্টগ্রামের বহু মুসলিম এ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।

স্বাধীনতার ভিত্তি প্রস্তুত

ডঃ আম্বা প্রসাদ বলেন, ১৯৪২ সালের এই আন্দোলন ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার ভিত্তি তৈরি করে। এতে ভারতীয়রা স্বাধীনতার স্বাদ পেতে শুরু করে।

অন্যান্য গুরুত্ব

১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সমস্ত ভারতীয় ঐক্যবদ্ধ হয়ে অংশগ্রহণ করে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে। ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক সমাজ এবং যুবসমাজ সক্রিয়ভাবে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনে মহিলাদের অংশগ্রহণ

নারী জাতির অবদান এই আন্দোলনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। গান্ধীজী নারীদের স্বাধীনতার জন্য অনুপ্রাণিত করেন, এবং সরোজিনী নাইডু, অরুণা আসফ আলি ও সুচেতা কৃপালিনী নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেন।

সরোজিনী নাইডু

তিনি সত্যাগ্রহ, আইন অমান্য আন্দোলন এবং লবণ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন এবং গান্ধীবাদী নেত্রী হিসেবে ভূমিকা পালন করেন।

অরুণা আসফ আলি

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী অরুণা আসফ আলি কংগ্রেস পতাকা উত্তোলন করে সাহসিকতার পরিচয় দেন।

সুচেতা কৃপালিনী

গান্ধীজীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সুচেতা কৃপালিনী কংগ্রেসের অন্যতম নেত্রী হিসেবে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।

অন্যান্য নেত্রী

উষা মেহতা, মাতঙ্গিনী হাজরা এবং কনক লতা বড়ুয়া এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মাতঙ্গিনী হাজরা প্রথম মহিলা শহীদ হন।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনে শ্রমিক শ্রেণীর ভূমিকা

বোম্বাই

৯ থেকে ১৪ আগস্ট, বোম্বাইয়ের শ্রমিক শ্রেণি আন্দোলনের অগ্রভাগে থেকে গণবিক্ষোভে অংশ নেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ গুলি চালালে বেশ কয়েকজন শ্রমিক আহত হয়।

গুজরাট

গুজরাটে প্রায় ১২,৬০০ শ্রমিক মজদুর মহাজন সংঘের নেতৃত্বে দীর্ঘ অনশনে যোগ দেন এবং ‘আজাদ সরকার’ প্রতিষ্ঠা করেন।

বিহার

বিহারের জামশেদপুরে টাটা আইরন অ্যান্ড স্টিলের প্রায় ৩০,০০০ শ্রমিক জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে ধর্মঘট করে।

মহীশূর

মহীশূরের শিল্পাঞ্চল এবং খনিতে শ্রমিক ধর্মঘট দেখা যায়। পুলিশ ও সেনাবাহিনী গুলি চালালে বহু শ্রমিক হতাহত হন।

অন্যান্য রাজ্য

দিল্লি, মুম্বাই, কানপুর, মাদ্রাজ এবং কলকাতার শ্রমিকদের মধ্যে স্বল্পস্থায়ী ধর্মঘট দেখা যায়। জাতীয় চেতনার সঙ্গে তাদের পেশাগত স্বার্থও জড়িত ছিল।

মূল্যায়ন

ভারত ছাড়ো আন্দোলন মূলত শহরকেন্দ্রিক ছিল। বিভিন্ন সামাজিক ও শিল্প শ্রেণির মানুষ যুক্ত থাকলেও গ্রামীণ শিল্পী ও কারিগররা এতে অংশ নেয়নি। মুসলিম লীগ, ডেমোক্রেটিক পার্টি এবং কমিউনিস্ট পার্টি এই আন্দোলনকে সমর্থন করেনি। তবুও শ্রমিক শ্রেণি জাতীয়তাবাদের পরিচয় দেয়।

4.5 / 5

- (24 votes)